ময়মনসিংহে গ্যাস পাম্পে বিস্ফোরণে এ পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। শোকের মাতম চলছে তাদের পরিবারে। স্বজনেরা এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চেয়েছেন। দুর্ঘটনা কবলিত এলাকাটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এ ঘটনায় এখনও কোনও আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। একই সঙ্গে চলা গ্যাস, এলপিজি ও পেট্রোলিয়াম পাস্প থাকা এবং দিনের বেলায় এলপিজি আনলোড করায় দুর্ঘটনায় হতাহত বেড়েছে দাবি স্বজনদের।তবে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম বলেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এখানে এক ধরনের গাফিলতি রয়েছে। এ ঘটনায় ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে তিতাস গ্যাস কর্মকর্তার দাবি, অগ্নিকাণ্ডটি ন্যাচারাল গ্যাস বা সিএনজি থেকে নয়, এলপিজি লরি আনলোডের সময়ে লিকেজ থেকেই ঘটেছে বিস্ফোরণ।ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল সড়কে ময়মনসিংহ নগরের রহমতপুর বাইপাস এলাকায় আজাহার ফিলিং স্টেশনে গত সোমবার বেলা পৌনে তিনটার দিকে হঠাৎ বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে ৭টি গাড়ি অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয়ে যায়। এর মধ্যে একটি প্রাইভেকটার, তিনটি সিএনজিসহ অন্যান্য গাড়ি রয়েছে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৭টি ইউনিটের টানা দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। গুরুতর আহত চারজন ঢাকায় ও দুজন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নিহত হয়েছেন তিনজন। মঙ্গলবার তাদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরে বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে এক ইসলামী সভায় যেতে নিজের প্রাইভেটকার নিয়ে বের হন হিমেল আহমেদ (৩২)। বাড়ির কাছের এলাকার সিএনজি পাম্পে গ্যাস নিতে গিয়ে বিস্ফোরণে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে মঙ্গলবার বেলা পৌনে তিনটার দিকে নিহত হিমেল আহমেদ মরদেহ আনা হয় কিসমত গ্রামের বাড়িতে। স্বজন ও এলাকাবাসী আহাজারি শুরু করেন। স্ত্রী ফাহিমা আক্তার ও মা হেনা আক্তার আহাজারি থামছেই না। ছেলের এমন মৃত্যু সইতে পারছেন না হেনা আক্তার।
নিহতের মামা সাজ্জাদ হোসেন খান মিলন বলেন, একসঙ্গে তিন ধরনের জ্বালানি নিয়ে পাম্পটি চলতে পারে না। এলপি গ্যাসের ট্যাংক থেকে গ্যাস রাতের বেলায় আনলোড করার কথা। কিন্তু দিনের বেলায় আনলোড করা হয়। আগুন নেভানোরও কোনও ক্যাপাসিটি নাই। আমার ভাগ্নে মারা গেছে, এর বিচার চাই।ভাঙারি কুড়িয়ে ও মানুষের কাছ হাত পেতে চলতেন বৃদ্ধ আবদুল কুদ্দুস (৮৫)। কিন্তু গ্যাস পাস্পে বিস্ফোরণে তিনিও মারা গেছেন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে বৃদ্ধ আবদুল কদ্দুসের মরদেহ নেয়া হয় সদর উপজেলার কিসমত গ্রামের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, স্বজনদের আহাজারি।স্বজনেরা জানান, আবদুল কদ্দুস রহমতপুর এলাকায় মেয়ে ময়না আক্তারের বাসায় বসবাস করতেন। ভাঙারি জিনিসপত্র কুড়িয়ে ও মানুষের কাছ হাত পেতে জীবন চালাতেন।
মেয়ে ময়না আক্তার বলেন, ওইদিন দুপুরে ১২ টার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় বাবা। মসজিদে নামাজ পড়ে হোটেলে ভাত খেয়ে পাম্পের কোনে প্রতিদিন বসে থাকে, চা খায়। সোমবার বিস্ফোরণে আগুনে শরীর পুড়ে যায়। তখন পোড়া শরীরে রাস্তা ধরে আমার বাসার দিকে হাঁটতে থাকে। রাস্তায় হাঁটছে দেখে প্রথমে চিনতে পারিনি, কারণ শরীরে কোনও পোশাক ছিল না। দৌড়ে কাছে গিয়ে দেখি, এতো আমার বাবা। পরে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
দুর্ঘটনাকবলিত পাম্পটির কোনে মুদি দোকান ছিল আবুল হোসেনের (৪৫)। তিনি নগরের ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের হারগোজিরপাড় এলাকার মনসুর হোসেনের ছেলে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে ঢাকায় নেয়ার পথে মঙ্গলবার রাতে মারা যান তিনি। রাত ১২ টার দিকে ঢাকা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি হাসপাতালে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরে রাতেই তার মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসা হয় বলে জানান ছোট ভাই মিয়া হোসেন। পরদিন সকালে জানাজা শেষে পারিবারিক গোরস্থানে মরদেহ দাফন করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত করা হয়নি।তিনি বলেন, আমার ভাই তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তার মৃত্যুতে পুরো পরিবার অসহায় হয়ে পড়েছে।
তিতাস গ্যাস ময়মনসিংহের ডিজিএম সুরঞ্জিত কুমার দে মঙ্গলবার দুপুর ২ টার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন। তিনি পুরো এলাকাটি ঘুরে দেখেন। তিনি বলেন, দুর্ঘটনা সংক্রান্ত আমাদের একটি স্থায়ী কমিটি রয়েছে। আমরা সরেজমিন ঘুরে একটি প্রতিবেদন দেব। এখানে তিতাস গ্যাস ছাড়াও এলপি ও পেট্রোলিয়াম ছিল। এখানে মূলত এলপি গ্যাস আনলোড করার সময়েই লিকেজ থেকে গ্যাস নির্গত হয়ে সেটি ছড়িয়ে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।এদিকে সিএনজি পাম্পটির ৫০০ মিটার এলাকায় যানবাহন ও মানুষের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে জেলা প্রশাসন। সেখানে রয়েছে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের অবস্থান। পাম্পের আশপাশে মানুষকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। রাস্তার দুই পাশে ব্যারিকেড দিয়ে রাখা হয়েছে। এদিকে ঘটনার পর থেকে লাপাত্তা মালিক আজহারুল ইসলাম। চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
ময়মনসিংহের কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মো. শফিকুল ইসলাম খান বলেন, ঘটনার পর থেকে পাম্পের মালিক পলাতক রয়েছে। তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের প্রস্তুতি চলছে।